সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: শিশুর চোখে চশমা? কেন?

শিশুর চোখে চশমা? কেন?


দেখো ডাকছে তোমায় আকাশটা, টিভি দেখো না/ দেখো ডাকছে তোমায় জানালার বাইরেটা, টিভি দেখো নানব্বইয়ের দশকে অঞ্জন দত্ত গানে গানে শিশুদের টিভি ছেড়ে আকাশ দেখতে বলেছিলেন। এখন অঞ্জন দত্তের দলে যোগ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আর টিভির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার, ট্যাব ও মুঠোফোন। চোখের চিকিৎসায় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা বলছেন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনে আসক্তি শিশুর চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। সময়ের আগেই তাদের চোখে তাই মাইনাস পাওয়ারের চশমা উঠছে।


দেশের প্রথিতযশা চক্ষু বিশেষজ্ঞ নিয়াজ আবদুর রহমান শিশুদের চোখে সমস্যার তিনটি কারণের কথা বলেছেন। গতকাল রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, কোনো কোনো শিশু চোখে সমস্যা নিয়েই জন্মায়। ভিটামিন র অভাবজনিত কারণে শিশু রাতকানা রোগে ভুগতে পারে, এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে শিশুরা চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না।

চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলেন, অক্ষিগোলকের আকৃতি যখন স্বাভাবিক থাকে,তখন প্রথমেই আলো গিয়ে পড়ে মানুষের চোখের মণিতে (কর্নিয়া)। সেখান থেকে মণির ভেতরের আরও কালো যে অংশ,সেই নয়নতারা (পিউপিল) ও লেন্স হয়ে আলো অক্ষিপটে (রেটিনা) পৌঁছায়। অক্ষিপটের কোষগুলো উদ্দীপিত হয়ে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠালে তবেই মানুষ দেখতে পায়। লম্বা সময় চোখের খুব সামনে রেখে শিশুরা যখন কম্পিউটার, ট্যাব বা মুঠোফোনে গেমস খেলে, তখন চোখ বিশ্রাম পায় না। চোখের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন,এ কারণে শিশুর চোখ আর চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না।

সারা দেশে ঠিক কত শিশু এমন সমস্যায় ভুগছে, তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো গবেষণা নেই। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা বলেছেন, মাসে হাসপাতালটিতে গড়ে ৩ হাজার ৭০০ শিশু আসে। এদের ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশ আই হসপিটালের তথ্যও একই। এই হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে আসা ৭০ শতাংশ শিশু একই রোগে ভুগছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ডাক্তারি ভাষায় রোগটিকে বলা হয় মাইয়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে এই রোগকে বলা হচ্ছে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম

সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও যেকোনো চশমার দোকানে শিশুদের জন্য গোলাপি,বেগুনি, নীল, সাদার ওপর ছোপছাপ করা বা হ্যালো কিটি (কার্টুনের চরিত্র) নকশা করা চশমার সমাহার বলে দেয়, কত শিশুর চশমা লাগছে। এর আগে ২০১৩ সালে ল্যানসেট এশিয়ায় ক্ষীণদৃষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ ছেপেছিল। ওই প্রবন্ধের লেখক ও গবেষক অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়ান জি মরগ্যানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোয় গত ৪০ বছরে ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিন গুণ হয়েছে। ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ বছর বয়সী তরুণদের ১৮ শতাংশ ক্ষীণদৃষ্টিতে ভুগত, ২০১১ সালে এই সংখ্যা ৯৬ শতাংশে দাঁড়ায়। হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ।

শিশুরা চোখে চাপ পড়া, মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, চোখ পিটপিট করার মতো সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসছে। সন্তান চশমা পরছে এমন একজন অভিভাবক বলেন, ছেলে কখনো চোখে কোনো সমস্যার কথা বলেনি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, বোর্ডে শিক্ষক যা লিখে দিচ্ছেন, সেটা ও তুলে আনতে পারছে না। চোখে সমস্যা হতে পারে, এই চিন্তা করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। পরে শুনলাম, আরও আগে আনা দরকার ছিল। ধানমন্ডির এক বাসিন্দা বলেন, আমার ছোট ছেলেটা ঘুষি দিয়ে বড়টার চোখ ফুলিয়ে দিয়েছিল। দুজনকেই সঙ্গে করে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, ছোটটার চোখে সমস্যা। সে অনবরত চোখ পিটপিট করছে। চোখ শুকিয়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসকেরা বলেন, চোখ শুকিয়ে যাওয়ার পেছনেও অন্যতম কারণ কম্পিউটার, ট্যাব, মুঠোফোন ও টেলিভিশনে আটকে থাকা। শিশুরা যখন কাছ থেকে এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করতে থাকে, মুঠোফোনে একমনে খেলতে থাকে, তখন চোখের মণি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। শিশুরা চোখের পাতা ফেলে না। পাতা ফেললে চোখের ভেতরের পানি চোখের মণিকে আর্দ্র করে। পাতা না ফেললে কর্নিয়ার যে পানি, তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আস্তে আস্তে চোখ শুকিয়ে যায়। শুষ্ক অনুভব করে বলে শিশু অনবরত চোখ পিটপিট করে।

শিশুদের কম্পিউটার-ট্যাব-মুঠোফোন, স্কুল-কোচিং-বাসায় পড়া, অনেক রাতে ঘুমাতে যাওয়া, খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠাএই চক্র থেকে বের করে আনার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এ ছাড়া শিশুদের চোখ নষ্ট হওয়ার জন্য বাংলাদেশের অভিভাবকদের টাইগার মম অ্যাটিচ্যুড (অতিরিক্ত চাপ দেওয়া মায়েদের বোঝানো হয়) থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করেছেন। প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার জন্য শিশুর ওপর বাড়তি পড়ার চাপও চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করতে পারে।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক অপথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শোভনা আলম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক অভিভাবক সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। অনেকে সময় দিতে পারলেও সন্তানকে বড় করার কষ্টটা করতে চান না। অনেকে আবার প্রযুক্তিকে আভিজাত্যের লক্ষণ মনে করেন। তাঁরা টেলিভিশন ছেড়ে বাচ্চাকে খাওয়ান, একটু বড় হলে মুঠোফোনে বা ট্যাবে গেমস খেলতে দেন। এভাবে আসলে অভিভাবকেরা নিজেরাই নিজেদের সন্তানের চোখের কবর খুঁড়ছেন।

বেসরকারি খাতে দেশের বড় একটি চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন এক নারী। তাঁর বড় ছেলে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, ছোটটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে। বড়টি দুই বছর আগেই চশমা নিয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শে এখন ছোটটিকেও এনেছেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডাক্তার তো বলছে কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইল না দিতে। ছেলে শোনে না। আর না দিয়েই বা কী করব? ফ্রেন্ডস সার্কেলে ওদের গল্পই তো গেমস নিয়ে। না দিলে তো পিছিয়ে যাবে।

দেশের নামকরা শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ আই হসপিটালের চিকিৎসক কাজী সাব্বির আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে একটি আই ক্যাম্পে আমরা ৯০০ শিশুর মধ্যে ১৩ জনের, মানে দশমিক ১৪ শতাংশ শিশুর চোখে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা পেয়েছিলাম। আর ঢাকায় আমার চেম্বারে যত শিশুর চোখ পরীক্ষা করি, তার প্রায় ৭০ শতাংশ এ রোগে ভুগছে। তাঁর মতে, ক্যারম বা লুডু ভিডিও গেমসের চেয়ে ভালো।

চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা যদি সূর্যের আলোয় অনেকটা সময় কাটায়, তাহলেই রোগমুক্ত থাকতে পারে। সে কারণেই গ্রামের শিশুদের তুলনায় শহরের শিশুরা ক্ষীণদৃষ্টি রোগে বেশি ভুগছে। কাজী সাব্বির আনোয়ার আরও বলেন, দৃষ্টিটাকে একদিকে নিবদ্ধ রাখলে চলবে না, দূরে তাকাতে হবে। আগেকার দিনে দাদি-নানিরা দূরের দিকে তাকিয়ে সবুজ দেখতে বলতেন। এতে চোখ আসলে বিশ্রাম পায়। কাছে ও দূরে দুইভাবে দেখাই চোখের কাজ। চোখকে তার স্বাভাবিক কাজটুকু করতে না দিলে দৃষ্টিশক্তি বাধাগ্রস্ত হবে। অনেক রাতে ঘুমিয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, জানালায় ভারী পর্দা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকতে না দেওয়া কিংবা রাতে বাতি জ্বেলে ঘুমালেও ক্ষীণদৃষ্টিতে ভোগার শঙ্কা তৈরি হয়

নিয়াজ আবদুর রহমান বলেন, বিনা মূল্যে শিশুদের ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ানোয় বাংলাদেশ থেকে এখন রাতকানা রোগ প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। তারপরও শিশুদের রঙিন শাকসবজি ও ছোট মাছ খাওয়া দরকার। একই সঙ্গে শিশুদের স্ক্রিনে সময় কাটানোর দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা দরকার। একটা সময়ে সরকারিভাবে স্কুলে চোখ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এই ব্যবস্থাটা চালু হওয়া খুব দরকার।


সূত্রঃ প্রথম আলো, আপডেট: , মে ২০, ২০১৬

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।