ইংল্যান্ডের উইকেট পতনের মিছিল দেখে মাইকেল ভন টুইট করেছেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না, তারা এমন খেলছে। ওরা তো ভালো খেলোয়াড়। ’ কেবল ভনকে কেন, অ্যাডিলেডে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ১৫ রানে হারিয়ে ইংলিশদের ১১ হাজার ভোল্টের শক দিল মাশরাফির দল! টিভি ক্যামেরা বহুবার খুঁজে ফিরল ইংলিশ সাজঘর। ওটা তো তখন সাজঘর নয়; যেন ‘শবঘর’! আর গোটা বাংলাদেশ শিবিরের তখন ‘আবেগে কাঁপিছে আঁখি’!
এ জয়ে নিশ্চিত হলো বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল। যদিও ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব পেরিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেবারের পরের রাউন্ড ছিল ‘সুপার এইট’। বাংলাদেশের নক আউট পর্বে খেলার অভিজ্ঞতা হবে এই প্রথম। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফিরা আজ ইতিহাস, স্রেফ ইতিহাসই গড়লেন অ্যাডিলেডে। ব্যাট হাতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করে ম্যাচসেরা হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। তবে শ্বাসরুদ্ধকর জয়ে ২৭ ও ৪৯ তম ওভারে ইংলিশদের দুটো করে আঘাত দিয়ে আসল নায়ক তো রুবেল হোসেনই। ২৭ তম ওভারের প্রথম ও চতুর্থ বলে বেল ও মরগানকে ফিরিয়ে ইংলিশদের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন রুবেল। এরপর শেষের দিকে মুঠো থেকে জয়টা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, ৪৯ তম ওভারে আবারও রুবেলের জোড়া আঘাত। তাতেই নিশ্চিত হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালি জয়গুলোর একটি।
২৭৬ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ইংল্যান্ডকে বেশ ভালো শুরু এনে দিল মঈন আলী-ইয়ান বেলের উদ্বোধনী জুটি। এ জুটিতে আসে ৪৮ রান। মঈন রানআউটের খাঁড়ায় ফিরলেন। এর পরে অ্যালেক্স হেলসকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন ইয়ান বেল। দুজনের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে আসে ৫৪ রান। ঠিক তখনই মাশরাফির আঘাত। ২৭ রান করা হেলসকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন ‘ম্যাশ’। তবে এ সময়ে ইংল্যান্ডের আসল সর্বনাশ করেন রুবেল। ইনিংসের ২৭ তম ওভারে প্রথমে ফিরিয়েছেন ৬৩ রান করা ইয়ান বেলকে। তিন বল পরই রানের খাতা খোলার আগেই ফিরিয়েছেন অধিনায়ক এউইন মরগানকেও। এরপর প্রতিরোধ গড়বেন কী, মাত্র ১ রান করে তাসকিনের শিকার হন জেমস টেলর। ১ উইকেটে ৯৭ থেকে ইংল্যান্ড হুট করে ৫ উইকেটে ১৩২! এরপর কিছুক্ষণ ভোগাতে চাইলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরিয়ান জো রুট। জস বাটলারকে নিয়ে ষষ্ঠ উইকেটে গড়লেন ৩১ রানের জুটি। রুটের শেকড় উপড়ে ফেললেন মাশরাফি। বাংলাদেশ অধিনায়কের বলে মুশফিকের ক্যাচে পরিণত হওয়ার আগে রুটের সংগ্রহ ২৯ রান। রুট ফিরলেও বাংলাদেশ আর জয়ের মাঝে ‘দেয়াল’ হয়ে দাঁড়ালেন বাটলার। এভাবেই ক্ষণে ক্ষণে রং বদলেছে ম্যাচ। যখনই মুঠো গলে বের হয়ে যাচ্ছিল ম্যাচ, তখন বাংলাদেশকে ম্যাচে ফিরিয়েছেন কেউ।
শেষ ৬০ বলে দরকার ছিল ৯৫ রান। ওভার প্রতি ৯.৫০ করে তুলতে হতো ইংল্যান্ডকে, হাতে ৪ উইকেট। ক্রমেই দূরে সরে যাওয়া জয়টাকে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করলেন বাটলার ও ক্রিস ওকস। দুজন সপ্তম উইকেট জুটিতে গড়লেন ৭৫ রান। বাংলাদেশের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের সপ্তম উইকেটে এটিই সর্বোচ্চ রান। বাটলার তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের সপ্তম ফিফটি। তাসকিনের বলে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দেওয়ার আগে করলেন ৫২ বলে ৬৫ রান। তবে বাংলাদেশকে চোখ রাঙানি দিচ্ছিলেন ওকস। অপর প্রান্তের সতীর্থদের অসহায় আত্মসমর্পণের মাঝে তিনি অপরাজিত ছিলেন ৪২ রানে। তাসকিনের করা ৪৮ তম ওভারে ওকসের সহজ ক্যাচ যখন ফেললেন তামিম, মনে হচ্ছিল ম্যাচটাও যেন ফেলে দিলেন। কিন্তু পরের ওভারেই রুবেলের সেই নায়ক হয়ে ফেরা। শেষ ২২ রানে ইংলিশদের পড়ল অবশিষ্ট ৪ উইকেট। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নিয়েছেন রুবেল। দুটি করে উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি ও তাসকিন। কেবল ব্যাট হাতেই নয়; গ্লাভস হাতেও দুর্দান্ত ছিলেন মুশফিক। উইকেটের পেছনে একাই ক্যাচ নিয়েছেন ৪ টি।
এর আগে প্রথমে ব্যাট করে মাহমুদউল্লাহর ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি ও মুশফিকের ৮৯ রানে ভর করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৭৫ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকের পঞ্চম উইকেট জুটিতে আসে ১৪১ রান। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে যেকোনো উইকেটে এটিই সর্বোচ্চ রানের জুটি। ৮ রানে দুই, আর ৯৯ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার ধাক্কাটা সামলে নিয়েছেন এই দুজন। মনে রাখতে হবে সৌম্যর ৪০ রানের ইনিংসটাও। হয়তো বলবেন বাড়াবাড়ি, তবে সত্য অস্বীকারের উপায় নেই, শিরোপা থেকে বাংলাদেশ ‘মাত্র’ তিন ম্যাচ দূরে! পয়েন্ট টেবিলের হিসাব অনুযায়ী, কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ। আর ২০০৭ বিশ্বকাপের স্মৃতি ফিরিয়ে ভারতকে হারাতে পারলে তারপর...থাক, ভবিষ্যৎ না হয় তোলাই থাক। আপাতত আনন্দের জোয়ারে ভাসুক গোটা বাংলাদেশ। আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসায় বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্ত দ্রবীভূত হোক লাল-সবুজেই।
সূত্রঃ প্রথম আলো, ০৯ মার্চ ২০১৫
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।